>জাসদ-গণবাহিনী সৈনিক সংস্থার বিপ্লবের চালচিত্র-২

>

ক্যান্টনমেন্ট থেকে জেনারেল জিয়াকে এলিফেন্ট রোডে নিয়ে এসে তাহেরের সাথে মিলিত হবার পর বিপ্লবের পরবর্তী কার্যক্রম শুরু হবে। তাহের প্রতীক্ষায় আছেন। হাবিলদার সিদ্দিক এসে জানান, জেনারেল জিয়া আসেননি। তিনি তাহেরকে টু ফিল্ড আর্টিলারীতে যেতে বলেছেন। একথা শুনে তাহের ভীষণ ক্ষেপে যান।







তাহের উত্তেজিত হয়ে বলেন : ‘তার মানে কি? তোমাদের না স্ট্রিক্টলি ইন্সট্রাকশন দিলাম জিয়াকে যেভাবে হোক, এখানে আনতে হবে। হাবিলদার সিদ্দিক বলেন : ‘আমরা স্যার ভাবলাম, উনি তো আপনারই মানুষ, উনি যখন বললেন, তখন আমাদের তাই করা উচিত।






তাহের ইনুকে বলেন : ‘এরা একটা রিয়েল ব্লান্ডার করে ফেলল। আমি চেয়েছিলাম আমাদের বিপ্লবের কেন্দ্রটাকে ক্যান্টনমেন্টের বাইরে নিয়ে আসতে। এখন যদি জিয়া ক্যান্টনমেন্টে থাকে, তাহলে তো সে তার পুরো ইনফ্লুয়েন্সটা ওখানে কাজে লাগাবে। আমাদের এখনই ক্যান্টনমেন্টে যাওয়া দরকার। [প্রাগুক্ত : পৃ-২৮৬]






রাজনৈতিক ইতিহাসের বিশ্লেষকদের মতে, জেনারেল জিয়াকে ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের করে এনে তাহের তার পূর্বপরিকল্পিত পরবর্তী কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করাতে ব্যর্থ হওয়ার মধ্যদিয়ে বাংলাদেশের ইতিহাসের গতিধারা বদলে দিয়েছে। তারা আরও মনে করেন, জেনারেল জিয়া ক্যান্টনমেন্ট ছেড়ে বাইরে এসে তাহেরের ‘বিপ্লবী কার্যক্রমের সাথে যুক্ত হলে প্রথমত তাঁর জীবন সংশয়াপন্ন হতে পারতো। দ্বিতীয়ঃ সেনাবাহিনীকে চেইন অব কমান্ডে আনা সম্ভব হতো না এবং সিরাজুল আলম খান-ইনু-তাহেরদের পরিকল্পনা মতো জাতীয় সেনাবাহিনী ধ্বংস হয়ে যেতো। কেননা তখন সেনাবাহিনীকে চেইন অব কমান্ডে এনে ঐক্য ও শৃ´খলাবদ্ধ করে জাতীয় আস্থা অর্জনে জেনারেল জিয়ার কোন বিকল্প ছিল না। জিয়ার একটি সিদ্ধান্তে জাতীয় ইতিহাসের গতিধারা ঘুরে যায় এবং ইতিহাসই জাতির ভবিষ্যৎকে জিয়ার হাতে তুলে দেয়।






বন্দি অবস্থা থেকে মুক্ত হয়ে জেনারেল জিয়া সতর্ক ও সাবধানী হয়ে ওঠেন। তিনি বাঘের থাবা থেকে বের হয়ে সাপের গর্তে পা ফেলার বোকামী করতে চাননি। জেনারেল জিয়ার শুভাকাঙ্ক্ী সেনা অফিসাররা তাঁকে ক্যান্টনমেন্টের বাইরে যেতে বারণ করেন। জেনারেল জিয়া সৈনিকদেরকে আরও কজন সেনা অফিসারকে তাঁর কাছে ডেকে আনতে বলেন। একে একে মীর শওকত আলী, আবদুর রহমান, নুরুদ্দীন প্রমুখ কর্নেল এবং ব্রিগেডিয়ার পর্যায়ের অফিসাররা এলেন। এবারে জেনারেল জিয়া বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সদস্যদের বলেন : ‘তোমরা বরং কর্নেল তাহেরকে এখানে নিয়ে আসো। আমি এখানেই তার সাথে মিলিত হতে চাই। [প্রাগুক্ত ২৮৪]






শাহাদুজ্জামান এভাবেই ঘটনা বর্ণনা করেছেন। তবে ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে অন্যরকম ভাষ্য থাকলেও এটা সত্যি যে, জেনারেল জিয়া তাহেরের ডাকে ক্যান্টনমেন্ট ছেড়ে তাদের বিপ্লবের আড্ডায় গিয়ে যোগ দেননি। বরং ক্যান্টনমেন্টে অবস্থান করে ঘটনাপ্রবাহের নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করে ইতিহাসের নায়ক হয়েছেন।






তাহের অগত্যা ক্যান্টনমেন্টে গিয়ে জেনারেল জিয়ার সাথে কথা বলার সিদ্ধান্ত নেন। এবারও জাসদ নেতা হাসানুল হক ইনু তাহেরের সহচর। শাহাদুজ্জামান লিখেছেন : ‘‘টু ফিল্ড আর্টিলারীতে পৌঁছালে সৈনিক সংস্থার লোকেরা তাহেরকে কোলে করে ট্রাক থেকে নামান। তাহেরের ক্র্যাচ ছিটকে পড়ে অন্যদিকে। তারা শ্লোগান দেন কর্নেল তাহের জিন্দাবাদ, জেনারেল জিন্দাবাদ। কাঁধে করে তাহেরকে তারা নিয়ে আসেন জিয়ার সামনে। [প্রাগুক্ত ২৮৮]






শাহাদুজ্জামানের বর্ণনা মতে, জিয়া তাহেরের সাথে কোলাকুলি করেন। এমনকি তিনি নাকি এও বলেন যে, ‘‘তাহের ইউ সেভড মাই লাইফ, থ্যাংক-ইউ। থ্যাংক ইউ সো মাচ।’’ [প্রাগুক্ত : পৃ-২৮৮]। তাহের বলেন, ‘আমি কিছুই করিনি, করেছে এই সিপাইরা। অল ক্রেডিট গোজ টু দেম।






উপস্থিত সেনা অফিসাররা তাহেরের মতো একজন অবসরপ্রাপ্ত সেনা অফিসারের সৈনিকদের নিয়ে মাঝ রাতে ক্যান্টনমেন্টে উপস্থিত হওয়ার তাৎপর্য ও কার্যকারণ নিয়ে নানা ধরনের প্রশ্ন আলোড়িত হয়। জেনারেল জিয়া তাহেরকে কেন ধন্যবাদ দিচ্ছেন এবং গুরুত্ব দিয়ে কথাবার্তা বলছেন, তা অনুধাবন করতে পারছিলেন না। জিয়ার বাইরে না যাওয়ার সিদ্ধান্তে ভেতরে ভেতরে ক্ষুব্ধ তাহের। তিনি জিয়ার সাথে একান্তে আলাপ করতে চান। এ সময় বঙ্গভবনে আটকে থাকা খালেদ মোশাররফের ক্যুর প্রধান সহকারী ব্রিগেডিয়ার শাফায়াত জিয়াকে ফোন করেন। জাসদ-তাহেরের সৈনিক সংস্থার লোকেরা তখন বঙ্গভবন দখল করে নিয়েছে। তার আগে তারা ক্যান্টনমেন্ট নিয়ন্ত্রণে নেবার অভিযান চালায় এবং অস্ত্রাগার দখল করে সাধারণ সৈনিকদের মাঝে অস্ত্র বিলি করে দেয়। শাফায়াত জিয়াকে জানান, ‘তিনি সিপাইদের কাছে সারেন্ডার করবেন না। শাফায়াতের ধারণা, জিয়াই এখন পুরো ঘটনা নিয়ন্ত্রণ করছেন। শাফায়াত জিয়াকে বললেন, ‘আপনি কিছু করবেন স্যার তো অফিসারদের নিয়ে করেন, এসব জোয়ানদের নিয়ে করতে গেলেন কেন? জেনারেল জিয়া শাফায়াতকে শান্ত হতে বলেন এবং সেখানে উপস্থিত তাহেরের সাথে কথা বলতে বলেন। শাফায়াতও অন্যান্য অফিসারদের মতো ক্যান্টনমেন্টে তাহেরের উপস্থিতিতে অবাক। তাহের ফোন ধরে শাফায়াতকে বলেন, ‘জাস্ট কোয়ায়েটলি সারেন্ডার। ভয় পাওয়ার কিছু নেই। এভরিথিং ইজ আন্ডার কন্ট্রোল।






শাফায়াত আত্মসমর্পণ করতে অস্বীকার করেন এবং তাহেরের সৈনিক সংস্থার লোকেরা বঙ্গভবন ঘিরে ফেললে, তিনি বঙ্গভবনের দেয়াল টপকে পালাতে গিয়ে তার পা ভেঙ্গে ফেলেন। এ সময় জেনারেল খালেদ মোশাররফ দৃশ্যপট ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছেন দশম বেঙ্গলে। এর মাত্র কদিন আগে শাফায়াত জামিলরা খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে খন্দকার মোশতাক ও আগস্ট ক্যুর মেজরদের বিরুদ্ধে পাল্টা অভ্যুত্থান করেন এবং জেনারেল জিয়াকে সপরিবারে স্ব-গৃহে বন্দি করে রাখেন, প্রেসিডেন্ট মোশতাককে বঙ্গভবনে বন্দুকের মুখে পদত্যাগে বাধ্য করেন। জেনারেল জিয়া অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে লিখিতভাবে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। একই সময় ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ র‌্যাংক পরিবর্তন করে নিজে নিজেই সেনা প্রধান পদে অধিষ্ঠিত হন।






তাহের জেনারেল জিয়ার সাথে বৈঠকে ২ নবেম্বর/৭৫-এর রাতে খালেদ মোশাররফের ক্ষমতা দখল করার পরের রাজনৈতিক ঘটনা ও পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করেন। বিশেষ করে কীভাবে তারা ‘বিপ্লব সংগঠন করেন জিয়াকে তার বর্ণনা দেন। তাহের এক পর্যায়ে জিয়াকে বলেন, ‘‘আমরা ঠিক করেছি আগামীকাল আমাদের প্রথম কাজ হবে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে একটা সমাবেশ করা। সেখানে জাসদ কর্মীসহ অন্যরাও থাকবে। সেখানে বক্তৃতার মাধ্যমে জনগণকে অভ্যুত্থানের ব্যাপারে স্পষ্ট ধারণা দিতে হবে। সেখানে আমি এবং আপনি বক্তৃতা দেবো।’’






জিয়া তাহেরকে বলেন : ‘দেখো তাহের, আমি তো পলিটিশিয়ান না, আমি জনসভায় ভাষণ দিতে পারবো না। বক্তৃতা তুমি দাও, তোমরা যা ভালো মনে করো সেটা করো। আমাকে সোহরাওয়ান্দী উদ্যানে টানাটানি করো না।’’ এরপরও তাহের পীড়াপীড়ি করতে থাকলে জিয়া বলেন : ‘‘তাহের তুমি এখন সিভিলিয়ান, তুমি গিয়ে বক্তৃতা দিতে পারো। আইএম নট গোয়িং আউট অব দিস ক্যান্টনমেন্ট।’’ কিছুক্ষণ পর তাহের আবারও জিয়াকে বলেন : ‘‘আপনি সমাবেশে বক্তৃতা না করতে চাইলে অন্তত রেডিওতে একটা বক্তব্য রাখেন। আপনি আমাদের সঙ্গে চলেন রেডিও স্টেশনে এবং একটা বক্তব্য রেকর্ড করে চলে আসবেন। [প্রাগুক্ত-পৃ-২৯০] পরিস্থিতি অনুধাবন করে সিনিয়র সেনা অফিসাররা জিয়াকে ঘিরে ফেলেছেন। জিয়া আবারও বললেন, তিনি কোথাও যাবেন না। তার পাশ থেকে ব্রিগেডিয়ার মীর শওকত এবং আমিনুল হকও বলেন, না স্যারকে এখন বাইরে নেয়া ঠিক হবে না। দরকার হলে বক্তৃতা এখানেই রেকর্ড করা হবে।’’ [প্রাগুক্ত-২৯১]






ফিরে আসার পথে ইনু বলেন, ‘জিয়া তো কোন কথা রাখবেন বলে মনে হচ্ছে না। তাহেরও স্বীকার করেন, জিয়াকে ক্যান্টনমেন্টের বাইরে আনতে না পারাটা একটা ব্লান্ডার হয়েছে। তাহের আরো বলেন, বিপ্লবের কেন্দ্র ক্যান্টনমেন্ট থেকে সরিয়ে একটা সিভিলিয়ান ডাইমেনশন দেয়ার পরিকল্পনা বরবাদ হতে যাচ্ছে। পরিস্থিতি ঘুরে যাবার আলামত স্পষ্ট। অফিসাররা জিয়াকে ঘিরে ফেলেছে। তাকে তারা আর ক্যান্টনমেন্টের বাইরে আসতে দেবে না বলে তাহের আশঙ্কা প্রকাশ করেন। তাহের মনে করেন, দ্র”ত কোন পাল্টা ব্যবস্থা নিতে না পারলে পুরো ব্যাপারটাই আমাদের কন্ট্রোলের বাইরে চলে যেতে পারে। তারা শহীদ মিনারের মিটিংয়ের কর্মসূচিও অব্যাহত রাখার কথা ভাবেন।






এদিকে তাহেরকে জানানো হয়, রেডিও স্টেশনে খন্দকার মোশতাককে দেখা যাচ্ছে। বক্তৃতা দেবার প্রস্তুতি নিচ্ছেন তিনি। খালেদ মোশাররফের ক্যু ব্যর্থ হওয়া এবং জিয়ার মুক্তির পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে প্রেসিডেন্সীর ধারাবাহিকতা রক্ষায় মোশতাক উদ্যোগ নিয়েছিলেন। বেঙ্গল ল্যান্সারের সিপাইদের সাথে করে মোশতাক রেডিও স্টেশনে আসেন।






রেডিও স্টেশনে মোশতাকের সাথে তাহের উদ্দীন ঠাকুর ছিলেন। তাহেরের সাথে আসা বেলাল মোশতাকের হাত থেকে কাগজ ছিনিয়ে নিয়ে তাহেরকে দেন। তাতে লেখা ‘কন্টিনিউশন অব প্রেসিডেন্সী। তাহের নিজেই ঐ কাগজ ছিঁড়ে ফেলেন এবং মোশতাককে বলেন : ‘‘কন্সপিরেসির দিন শেষ। ইউ হ্যাভ ক্রিয়েটেড এনাফ ট্রাবল ফর দিস ন্যাশন। নাউ গেট আউট ফ্রম দিস রেডিও স্টেশন। তা না হলে আপনার জিহবা আমি টেনে ছিঁড়ে ফেলবো।’’ শাহাদুজ্জামান লিখেন: ‘‘হাবিলদার হাই এক রকম টেনে মোশতাক এবং তাহের উদ্দীনকে বাইরে নিয়ে যান। মোশতাক কোনো উচ্চ-বাচ্য করেন না।’’ [প্রাগুক্ত-২৯২]






এ সময় ক্যান্টনমেন্টে রেকর্ড করা জিয়ার বক্তৃতা প্রচারিত হয় রেডিওতে। তাতে জেনারেল জিয়া নিজকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে ঘোষণা করেন। জাসদ কিংবা তাহেরের দৃশ্যপটে আসার পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। প্রথম দিকের স্লোগান ছিল : ‘‘সিপাহী-সিপাহী ভাই ভাই’’ দৃশ্যপট পরিবর্তনের সাথে সাথে তা বদলে গিয়ে দাঁড়ায় : ‘‘সিপাহী-জনতা ভাই ভাই-তে।’’ জাসদ-নিয়ন্ত্রিত ও তাহেরের কমান্ডে পরিচালিত ‘সৈনিক সংস্থার অফিসার নিধন এবং পিপলস আর্মির কনসেপশন সেনাবাহিনীর শীর্ষ পর্যায়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। ফলে ক্যান্টনমেন্টে নতুন করে জেনারেল জিয়ার পক্ষে নয়া মেরুকরণ ঘটে। এতে জেনারেল জিয়ার পরিস্থিতির ওপর নিয়ন্ত্রণ সহজতর হয়। ব্যক্তি জিয়ার প্রতি সাধারণ মানুষের যে আস্থা তৈরি হয়েছিল স্বাধীনতার ঘোষণা ও মুক্তিযুদ্ধের মধ্যদিয়ে সেটা জাতীয় ক্রান্তিকালে আরো সংহত ও প্রসারিত হয়। ক্ষমতার পালাবদলে সেনাপ্রধান জিয়াকে বন্দিত্ব বরণ করতে হয়, এমনকি সেনাপ্রধানের পদ থেকেও তাকে এক পর্যায়ে পদত্যাগ করতে হয়। সৈনিকরা এক দুঃসহ ও অনিশ্চিত বন্দিদশা থেকে জিয়াকে মুক্ত করেন। জাসদের মেজর জলিলও তখন বন্দী। রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহের নেপথ্যচারী তাত্ত্বিক সিরাজুল আলম খান কিংবা কর্নেল তাহের ইমেজ ও অবস্থানের দিক থেকে জেনারেল জিয়ার বিকল্প ছিলেন না।






কিন্তু জিয়াকে না পেলেও জাসদ তার ‘গণবাহিনী নিয়ে পরিকল্পনা মতো তৎপরতা চালিয়ে যায়। ৭ই নবেম্বর সকাল থেকেই জাসদের গণবাহিনী শহরের বিভিন্ন স্থানের নিয়ন্ত্রণ নিতে শুরু করে। শহীদ মিনারে জনসমাবেশের আয়োজনও তারা চালাতে থাকে। সায়েন্স এনেক্স বিল্ডিংয়ের একটা কক্ষে ঢাকা নগর গণবাহিনীর কন্ট্রোল রুম বসানো হয়। গণবাহিনীর সদস্যরা মহম্মদপুর থানাসহ শহরের কয়েকটি থানা দখল করে নেয়। পুলিশ তাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে। অন্য দিকে শহীদ মিনারে গণবাহিনীর সদস্য আবুল হাসিব খান মাইকে ঘোষণা করেন, একটু পরেই শুরু হবে ঐতিহাসিক লং মার্চ। লং মার্চে নেতৃত্ব দিবেন কমরেড আবু তাহের, কমরেড জিয়াউর রহমান…






উল্লেখ্য, অভ্যুত্থানের প্রথম পর্বে তাহেরের ভূমিকা থাকলেও দ্বিতীয় পর্বে জাসদ গণবাহিনীর মাধ্যমে পরিস্থিতির ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ লাভে তৎপর হয়। শহীদ মিনারেও তেমন জনসমাগম ঘটাতে পারেনি তারা। সিরাজুল আলম খান তখনও দৃশ্যপটে আবির্ভূত হননি। তিনি অজ্ঞাত স্থানে আত্মগোপন অবস্থা থেকে টেলিফোনে যোগাযোগ রাখছেন। শহীদ মিনারে গণবাহিনী জাসদপন্থীদের সাথে রশিদ-ফারুক সমর্থকদের সংঘর্ষ, গুলী বিনিময় ঘটে। এতে গণবাহিনীর সমাবেশ পন্ড হয়ে যায়।






রেডিও স্টেশন থেকে খন্দকার মোশতাককে বের করে দিয়ে তাহের দ্বিতীয়বার টু ফিল্ড আর্টিলারে গমন করেন। সেখানে উচ্চপদস্থ সেনা অফিসাররা জেনারেল জিয়ার সাথে বৈঠকে ছিলেন। এতে তাহেরকে ডাকা হয়নি। তাহের এক প্রকার অনাহূত অবস্থায় মিটিংয়ে ঢুকে পড়েন। অন্যদের মধ্যে উপস্থিত জেনারেল উসমানি তাহেরকে বলেন, ‘কাম অন তাহের হ্যাভ এ সিট। [প্রাগুক্ত-২৯৫]






ক্যান্টনমেন্টের ঐ সভায় মোশতাকের প্রতিনিধি মাহবুবুল আলম চাষীও উপস্থিত ছিলেন। তিনি তাহেরকে জানান, বর্তমান অবস্থায় সরকারের প্রেসিডেন্ট হিসেবে খন্দকার মোশতাককে বহাল রাখার সিদ্ধান্ত তারা নিয়েছেন। তাহের প্রতিবাদ করে বলেন, তাহলে এখানে থাকার তার কোনো প্রয়োজন নেই। খন্দকার মোশতাককে দৃশ্যপট থেকে দূরে রাখার কথা বলায় জেনারেল উসমানি তাহেরের পরিকল্পনা কী; তা জানতে চান।






এ পর্যায়ে তাহের জানান, তারা চান বিপ্লবী পরিষদ ও সর্বদলীয় জাতীয় সরকার/বিকল্প প্রেসিডেন্ট হিসেবে তদানিন্তন প্রধান বিচারপতি সায়েমের প্রস্তাব এলে তাহের তাতে সমর্থন দেন। সেনাপ্রধান হিসেবেও তাহের জিয়াকে মেনে নেন। শাহাদুজ্জামান লিখেছেন : “তাহের ভেবেছিলেন জিয়াকে ব্যবহার করে পরিস্থিতি তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখবেন। এখন উল্টো জিয়া তাহেরকে ব্যবহারের চেষ্টা করছেন। অভ্যুত্থানের আদর্শকে যেন জিয়া বিপথগামী করতে না পারেন, সেজন্য তাহের চেষ্টা চালিয়ে যান জিয়াকে যতোটা সম্ভব তার নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনতে। সিপাইদের মুখোমুখি হলে, তাহের জিয়াকে বলেন : “আপনি জোয়ানদের উদ্দেশে কিছু বলেন। জিয়া খুব সংক্ষেপে বলেন : আমি রাজনীতি বুঝি না। ধৈর্য ধরেন। নিজের ইউনিটের শৃ´খলা বজায় রাখেন। আপনাদের দাবিগুলো লিখিত দেন।’[প্রাগুক্ত-২৯৫]






এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, তাহের জেনারেল জিয়াকে সামনে রেখে ক্যান্টনেমেন্ট ও রাজনীতিকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেয়ার সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি নিয়েছেন। বিশেষ করে, সৈনিক সংস্থার মাধ্যমে তাহের সেনা অফিসার হত্যা করে তার পিপলস আর্মি প্রতিষ্ঠার পথ পরিষ্কার করতে চাইছেন। সেনাপ্রধান হিসেবে জেনারেল জিয়া এই হঠকারী বিপ্লবের সাথে হাত মিলালে তাঁর নিজের ভবিষ্যৎ যেমন বিপন্ন হতো, তেমনি সেনাবাহিনীর প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোও ধ্বংস হয়ে যেতো। তাহের বুঝতে পারছিলেন, জেনারেল জিয়া তাদের বিপ্লবকে সহায়তা দিবেন না। জিয়াকে সমর্থন দিয়ে কারাবন্দী জাসদ নেতাদের বের করে আনাও তাহেরের অন্যতম লক্ষ্য ছিল। আপাততঃ খন্দকার মোশতাককে হটাতে পারলেও তাহের বুঝতে পারেন, জেনারেল জিয়াই তাদের বিপ্লব বাস্তাবয়নের পথে প্রধান অন্তরায়। এদিকে দ্বিতীয়বার টুফিল্ড আর্টিলারীতে গিয়ে তাহের জানতে পারেন খালেদ মোশাররফকে হত্যা করা হয়েছে। যে ইউনিটে খালেদ মোশাররফ আশ্রয় নিয়েছিলেন, ঐ ইউনিটের দু’তিন সিনিয়র অফিসারের হাতে খালেদ মোশাররফ নিহত হন।






একপর্যায়ে গোপন আস্তানা থেকে সিরাজুল আলম খান বেরিয়ে আসেন। মিটিং শুরুর আগে তাহেরের ভাই ইউসুফ তাহেরের উপস্থিতিতে সিরাজুল আলম খান ও ড. আখলাকের নিষ্ক্রিয় ও রহস্যজনক ভূমিকা নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেন। কার্যতঃ বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে প্রত্যাশিত সাফল্য ও সমর্থন অর্জন করতে পারেনি। বরং তারা প্রতিরোধের মুখোমুখি হয়। খালেদ মোশাররফের পাল্টা ক্যু-তে কোণঠাসা হয়ে পড়া ফারুক-রশীদের অনুসারী সৈনিকরা বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সাথে কৌশলগত কারণে হাত মিলালেও পরিস্থিতির পরিবর্তনে তারা পক্ষ ত্যাগ করে নিজস্ব ভূমিকা গ্রহণ করেন। জিয়াও তাহের-সিরাজুল আলম-ইনু চক্রের হাত ছাড়া। এরপরও তাহের হাল না ছেড়ে বলেন : ‘আমাদের সময় খুব কম। হাল ছেড়ে দেয়া যাবে না। জিয়াকে আমাদের গ্রীপে আনতে হবে। জিয়া বলেছেন, লিখিত আকারে সৈনিকদের দাবি-দাওয়াগুলো তাকে দিতে। এখন আমাদের প্রথম কাজ হবে, সৈনিকদের দাবি-দাওয়াগুলো লিখে ফেলা এবং তারপর সেগুলো তাঁর কাছ থেকে সই করিয়ে নেয়া। আজকের মধ্যেই (৭ নবেম্বর) তার সই নিতে হবে এবং তারপর তাঁকে বাধ্য করা হবে ঐ দাবিগুলো মানতে। সিরাজ ভাই আপনি কি বলেন,[প্রাগুক্ত-২৯৭] সিরাজুল আলম তাহেরের এ প্রস্তাব সমর্থন করেন।






বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সদস্যদের ক্ষিপ্ত করে সেনা অফিসার নিধনযজ্ঞ শুরু করা হলেও সাধারণ সৈনিকদের নিজস্ব স্বার্থ ও এজেন্ডাসমূহ কী, তা তাদের জানানো হয়নি। এক অর্থে সৈনিকদের অন্ধকারে রেখে তাদেরকে ব্যবহার করা হয়েছে। জেনারেল জিয়া সৈনিকদের দাবি পেশ করতে বলে একদিকে সৈনিকদের আত্মোপলব্ধির যেমন সুযোগ করে দিয়েছেন, তেমনি তাহেরকেও মহাপরীক্ষায় ফেলেন।






সিপাহীরা নিজেদের মতো করে একটা চার্টার অব ডিমান্ড-খসড়া তৈরি করলেও সিরাজুল আলম খান, তাহের, ইনু-রা মিলে সেটা পরিমার্জন ও সংযোজন করে ১২ দফা রচনা করেন। এর প্রথম দফা হচ্ছে এ রকম : ‘‘আমাদের বিপ্লব, নেতা বদলের জন্য নয়, বিপ্লব হয়েছে সাধারণ মানুষের স্বার্থে। এতদিন আমরা ছিলাম ধনীদের বাহিনী, ধনীরা তাদের স্বার্থে আমাদের ব্যবহার করেছে। পনেরই আগস্ট তার প্রমাণ। তাই এবার আমরা ধনীর দ্বারা বা ধনীদের স্বার্থে অভ্যুত্থান করিনি। আমরা বিপ্লব করেছি জনগণের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে। বাংলাদেশের সেনাবাহিনীকে ‘গরীব শ্রেণীর স্বার্থরক্ষাকারী- গণবাহিনী হিসেবে গড়ে তোলা আমাদের কাজ। ১২ দফার চার দফায় রয়েছে : অফিসার এবং জওয়ানদের ভেদাভেদ দূর করতে হবে। অফিসারদের আলাদাভাবে নিযুক্ত না করে, সামরিক শিক্ষা এবং যোগ্যতা অনুযায়ী সামরিক বাহিনী থেকেই পদমর্যাদা নির্ণয় করতে হবে। অফিসার ও জওয়ানদের এক রেশন এবং একইরকম থাকার ব্যবস্থা করতে হবে। যে সমস্ত সামরিক অফিসার এবং জওয়ানদের বিদেশ পাঠানো হয়েছে, তাদের দেশে ফেরত আনতে হবে। জওয়ানদের বেতন হবে সপ্তম গ্রেডে, ফ্যামিলি এ্যাকোমোডেশন ফ্রি দিতে হবে। পাকিস্তান ফেরত সামরিকবাহিনীর লোকদের আঠারো মাসের বেতন দিতে হবে।






রেডিও স্টেশন তখনও তাহেরের সৈনিক সংস্থার নিয়ন্ত্রণে। তাহের জানেন, বিকালে সায়েম আসবেন নতুন রাষ্ট্রপতি হিসেবে ভাষণ দিতে, সাথে থাকবেন বিদায়ী রাষ্ট্রপতি মোশতাক এবং জিয়াও উপস্থিত থাকবেন। সন্ধ্যার দিকে জিয়া রেডিও স্টেশনে গেলে সৈনিকরা তাকে ঘিরে ধরেন এবং দাবি-দাওয়াগুলো পেশ করেন। সৈনিকরা তখন উদ্ধত। তারা বলেন, দাবি মেনে নেয়া না হলে জিয়াকে রেডিওতে ঢুকতে দেয়া হবে না, এমনকি রাষ্ট্রপতিকেও না।






পরিস্থিতি বিশ্লেষণে আবারও প্রমাণ হলো সৈনিকদের দাবি-দাওয়া বিবেচনা কিংবা অন্য কোন সিদ্ধান্ত কার্যকর করার মূল কেন্দ্রবিন্দু জিয়া। যারা বিপ্লব করেন, তারা কারও কাছে দাবি পেশ করে তা বাস্তাবয়নের প্রতীক্ষায় থাকেন না। কর্মসূচি প্রণয়ন করে তারা নিজেরাই বাস্তবায়ন করেন। কিন্তু তাহের সৈনিক সংস্থা ও জাসদের হাত থেকে ঘুড়ির নাটাই ফসকে গেছে। উপস্থিত মতে, বেশ কিছু দাবি জিয়া মেনে নেন। তাহের দাবিনামায় জিয়ার সই দাবি করেন। জিয়া তিন কপি দাবিনামায় সই করে এক কপি নিজের কাছে রাখেন। জিয়া তাহেরের সাথে আর কোন কথা না বলে রেডিও স্টেশনে ঢুকে যান। সন্ধ্যায় নতুন রাষ্ট্রপতি হিসেবে বিচারপতি সায়েম ভাষণ দেন।

1 thoughts on “>জাসদ-গণবাহিনী সৈনিক সংস্থার বিপ্লবের চালচিত্র-২

  1. পিংব্যাকঃ পঁচাত্তরের নভেম্বরঃ নাগরদোলায় উত্থান, পতন ও অবস্থান (তৃতীয় পর্ব) - নিয়ন আলোয়

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান